কুরবানির শিক্ষা


 

কুরবানির শিক্ষা

 

 

ভূমিকা- মুসলমানদের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ উৎসব ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ।

 

কুরবানির অর্থ-

শাব্দিক দিক : আরকুরবানশব্দটিকুরবাতুনশব্দ থেকে উৎপন্ন।এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে : নিকটবর্তী হওয়া।

নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম। যেমন বলা হয়- “সৎকর্ম দ্বারা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া

কুরবানির অর্থ : সৎকাজ, নৈকট্য, সন্নিকটে, ঘনিষ্ঠ হওয়া।

কুরবানি- উৎসর্গ, আত্মীয়তা, সান্নিধ্য।

শরীয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ্জ মাসের ১০, ১১, ১২ এই তিনটি দিনে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল পশু জবেহ করাই হল কোরবানি। ত্যাগ, তিতীক্ষা প্রিয়বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করাই কোরবানির তাৎপর্য। তাই কুরআনেকুরবানী বদলেকুরবানশব্দটি মোট তিন জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে যেমন১. নং সূরা আলইমরানের ১৮৩ নং আয়াত, . নং সূরা মায়িদা ২৭ নং আয়াত এবং . নং সূরা আহক্বাফের ২৮ নং আয়াত।

কুরআনুল কারিমের কুরবানির একাধিক সমার্থক শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।

>>نحر অর্থে। আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামাজ এবং কুরবানি আদায় করুন। কারণে কুরবানির দিনকে يوم النحر বলা হয়।

>> نسك অর্থে। আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু; সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।’ (সুরা আনআ : আয়াত ১৬২)

>> منسك অর্থে। আল্লাহ বলেন, ‘ لِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً ‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কুরবানির বিধান রেখেছি।’ (সুরা হজ্জ : আয়াত ৩৪)

>> الاضحى অর্থে। হাদিসের ভাষায় অর্থে কুরবানির ঈদকে (عيد الاضحى) ‘ঈদ-উল-আজহাবলা হয়।

কুরবানির ইতিহাস-   হযরত আদম () থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিটি ধর্মে, সকল যুগে কুরবানির প্রথা চালু রয়েছে। যদিও একেক ধর্মের নিয়ম পদ্ধতি একেক ধরনের। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে যেহেতু প্রত্যেক নবীর যুগে কুরবানির বিধান ছিল সেহেতু এর গুরুত্ব অত্যধিক। যেমন ইরশাদ হয়েছে- “আর আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি। তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জীব দিয়েছেন সেগুলোর ওপর তারা যেন আল্লাহর নাম স্মরণ করে।” (সূরা আল হজ-৩৪)

আয়াতের ব্যাখায় আল্লামা আলুসি (রহ) বলেন- “আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানির প্রথা সকল আসমানি ধর্মে বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।

মানুষের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানির প্রচলন করা হয় হযরত আদম () এর পুত্র হাবিল কাবিলের হাতে। কুরআনে সূরা আল মায়েদায় বলা হয়েছেএবং আদম পুত্রদ্বয়ের সত্য ঘটনা লোকদের শোনাও। যখন তারা উভয়ে কুরবানি পেশ করে। অতঃপর একজনের (হাবিল) কুরবানি কবুল হয়। এবং অপরজনের (কাবিল) অগ্রাহ্য হয়। তখন (কাবিল) সে তাকে (হাবিলকে) বলে, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। (হাবিল) সে বলে আল্লাহ পরহেজগারিদের কুরবানিই কবুল করেন। (আয়াত : ২৭)

তাফসিরে হাক্কানিতে বলা হয়েছেহজরত মূসা, ইয়াকুব, ইসহাক ইবরাহিম () এর শরিয়তসমূহে কুরবানি করা ধর্মেও আইনরূপে স্বীকৃত ছিল।

চলিত কোরবানি হযরত ইবরাহিম . এর অপূর্ব আত্মত্যাগের ঘটনারই স্মৃতিবহ। হাদীসে বর্ণিত আছে: ‘রাসূলুল্লাহর (সা.) সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোরবানি কী? তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (.)-এর সুন্নাত। তাঁরা বললেন, এতে আমাদের কি কল্যাণ নিহিত আছে?’

কোরবানির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন হজরত ইবরাহিম : হজরত ইসমাঈল : মহান আল্লাহর জন্য হজরত ইবরাহিম :-এর সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ এবং হজরত ইসমাঈল :-এর আত্মোৎসর্গ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দ হলো যে, তিনি ইব্রাহিম :-কে আপন বন্ধুরূপে (খলিলুল্লাহ) গ্রহণ করলেন। শুধু তা- নয়, মহান আল্লাহ তাকে মুসলিম জাতির পিতার আসনে অভিষিক্ত করলেন এবং তার ছেলে ইসমাঈল :-এর পবিত্র বংশধারায় সর্বশেষ সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর উত্থান ঘটালেন। তিনি হজরত ইব্রাহিম : হজরত ইসমাঈল :-এর ত্যাগের ইতিহাসকে চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য সর্বকালের সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানিকে বাধ্যতামূলক করলেন।

কুরবানির উদ্দেশ্য-

কুরবানীর মূল উদ্দশ্য আল্লাহভীতি অর্জন করা। যাতে মানুষ এটা উপলব্ধি করে যে, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কারণেই শক্তিশালী পশুগুলি তাদের মত দুর্বলদের অনুগত হয়েছে এবং তাদের গোশত, হাড়-হাড্ডি-মজ্জা ইত্যাদির মধ্যে তাতের জন্য রুযী নির্ধারিত হয়েছে। জাহেলী যুগের আরবরা আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের অসীলা হিসাবে তাদের মূর্তির নামে কুরবানী করত। অতঃপর তার গোশতের কিছু অংশ মূর্তিগুলির মাথায় রাখত তার উপরেই কিছু রক্ত ছিটিয়ে দিত। কেউবা উক্ত রক্ত কাবা গৃহের দেওয়ালে লেপন করত। মুসমানদের কেউ কেউ অনুরুপ করার চিন্তা করলে নিম্নের আয়াতটি নাযিল হয়।[]

আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ

অর্থঃ কুরবানীর পশুর গোশত বা রক্ত আল্লাহর নিকটে পৌছে না। বরং তার নিকটে পৌছে কেবল মাত্র তোমাদেরতাক্বওয়াবা আল্লাহ ভীতি (হজ্জ ৩৭)

 

এছাড়া কুরবানীর আরো একটি উদ্দেশ্য রয়েছে এর মধ্যে প্রথমত কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর একজন বান্দা কথা স্বীকার করে নেয় যে, আল্লাহই একমাত্র মুনিব এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ সারা দুনিয়ার মানুষের উপাসনা/ ইবাদত পাওয়ার একমাত্র অধিকার তারই, তিনিই সার্বভৌমত্বের মালিক এবং তার বিধান ছাড়া আর কারও বিধান মানা যায় না, মানা যেতে পারে না তারই বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে কোন ত্যাগ কুরবানীর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

কুরবানির শিক্ষা-

আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ সব কিছুই মহান আল্লাহর দান। পরম প্রভুর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির শিক্ষা। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বান্দার গোলামি প্রকাশ পায়, তার প্রভুর জন্য তার ভালোবাসা ত্যাগের মাত্রা নির্ণীত হয়। আল্লাহর দান আল্লাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত, তারই একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। আমাদের জীবনসম্পদ আল্লাহর কাছে উৎসর্গ করার প্রতিশ্রুতিই গ্রহণ করি কোরবানির মাধ্যমে। কোরবানির দোয়ার মধ্যে মৌলিক যে কথাটি আমরা বলি তা হলোÑ “আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন আমার মৃত্যু সারা জাহানেররবআল্লাহর জন্য” (সূরা আনআম-১৬২) মূলত আমাদের জীবন সম্পদের মালিক আল্লাহ। দুটো জিনিস আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যয় করাই ঈমানের অপরিহার্য দাবি এবং জান্নাত লাভের পূর্বশর্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনের জীবন সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন’ (সূরা তওবা-১১০) কাজেই জীবনসম্পদ আল্লাহর এবং তা আমাদের কাছে আমানত। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তার পছন্দনীয় পথে ব্যয় করাই ঈমানের দাবি। কোরবানি মানুষকে ঈমানের দাবি পূরণের উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।

কুরবানির মাসয়ালা-

যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন যুলহাজ্জ মাসের চাঁদ দেখার পর শরীরের কোনো অংশের চুল না কাটে, মাথা না মোড়ায় এবং নখ না কাটে। কুরবানী করার পর চুল, নখ ইত্যাদি কাটবে। আমল মসনূন, ওয়াজিব নয়। যার কুরবানী করার সামর্থ্য নেই, তার জন্যেও এটা ভালো যে, সে কুরবানীর দিন কুরবানীর পরিবর্তে তার চুল কাটবে, নখ কাটবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। কাজ তার কুরবানীর স্থলাভিষিক্ত হবে।

হযরত উম্মে সালাম (রা) বলেন, নবী () বলেছেন, যার কুরবানী করতে হবে সে যেন চাঁদ দেখার পর যতক্ষণ না কুরবানী করেছে ততোক্ষণ চুল নখ না কাটে।(মুসলিম, জামউল ফাওয়ায়েদ)

হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) বলেন, নবী () বলেছেন, আমাকে হুকুম করা হয়েছে যে, আমি যেন ঈদুল আযহার দিনে (যুলহজ্জের দশ তারিখে) ঈদ পালন করি। আল্লাহ তায়ালা দিন উম্মতের জন্যে ঈদ নির্ধারিত করেছেন। একজন জিজ্ঞেস করলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বলুন, একজন আমাকে দুধ পানের জন্যে একটা বকরী দিয়েছেন। এখন বকরী কি আমি কুরবানী করব? নবী () বলেন, না তুমি তা কুরবানী করবে না। কিন্তু কুরবানীর দিন তোমার চুল ছাঁটবে, নখ কাটবে, গোঁফ ছোট করবে এবং নাভির নীচের চুল সাফ করবে। বাস আল্লাহর কাছে তোমার পুরো কুরবানী হয়ে যাবে। (জামউল ফাওয়ায়েদ, আবু দাউদ, নাসায়ী)

 

সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্ত বয়স্ক, মুকীম (মুসাফির নয় এমন ব্যক্তি) ব্যক্তিই ১০ যিলহজ্জ ফজর হতে ১২ যিলহজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নিসাব (সাড়ে সাত তোলা সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা সেই পরিমাণ নগদ অর্থ)পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে তার উপর কোরবানি করা ওয়াজিব। কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য জাকাতের নিসাবের মত সম্পদের এক বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। বরং যে অবস্থায় সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয় অবস্থায় কোরবানিও ওয়াজিব হবে।

নেক আমলসমূহের মধ্যে কোরবানি একটি বিশেষ আমল। কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) সব সময় কোরবানি করেছেন এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি বর্জনকারী ব্যক্তির প্রতি তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।


শেষ কথা-

মুসলমানদের জীবনে কোরবানির গুরুত্ব আনন্দ অপরিসীম। উৎসব হিসেবে পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি এর সাথে সম্পৃক্ত। ইসলামের জীবন আর ধর্ম একই সূত্রে গাথা। তাই কোরবানির শুধু আনন্দের উৎস নয় বরং এর সাথে জড়িয়ে আছে কর্তব্যবোধ, সহমর্মিতা ভ্রাতৃত্ববোধে বৈশিষ্ট্য। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সম্প্রীতির ভাবটা এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

এলাকার লোকেরা ঈদের নামাজের জন্য নির্দিষ্ট ঈদগাহে সমবেত হয়। এতে সকলের মধ্যে একাত্মতা সম্প্রীতি ফুটে ওঠে- ইসলামের মহান ভ্রাতৃত্ববোধে সবাই উদ্দীপ্ত হয়। পরস্পর কোলাকুলির মাধ্যমে সব বিভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই বলে গৃহীত হয়। ধনী গরীবের ব্যবধান তখন প্রাধান্য পায় না। ঈদের আনন্দ সবাই ভাগ করে নেয়। এর ফলে ধনী গরীব, শত্রুমিত্র, আত্মীয়স্বজন সবাই পরস্পর ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে থাকে।

ঈদ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভোলার জন্য, মানুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হওয়ার জন্য পরম মিলনের বাণী নিয়ে আসে। ঈদ উল আজহার যে কোরবানি দেয়া হয় তার মাধ্যমে মানুষের মনের পরীক্ষা হয়, কোরবানির রক্তমাংস কখনই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। শুধু দেখা হয় মানুষের হৃদয়কে। ঈদের মধ্যে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়। পরোপকার ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন।

Post a Comment

0 Comments